সাইমন সিনেক এর ‘স্টার্ট উইথ হোয়াই’ থেকে শেখার মত ৩ টি বিষয়

·

বিজনেস বা মার্কেটিং নিয়ে যে কারো সাথে ডিসকাশনের সময় আমার মুখ থেকে অটোমেটিক সাইমন সিনেক নামটি চলে আসে। যেকোনো বিজনেস বা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন ডিজাইন এবং ডেভেলপ করার সময় আমি তার Start With Why বইতে মেনশন করা Golden Circle ফলো করার আপ্রাণ চেষ্টা করি।

তার বইয়ের সারমর্ম লেখার মত জ্ঞান বা ধৃষ্টতা, কোনটাই আমার নেই। হাবস্পট এর টুইটার একাউন্ট থেকে বেন এর লেখা একটি পোস্ট পেয়েছিলাম। সেখানে তিনি যে প্রধান ৩ টি বিষয় উল্লেখ করেছেন, তার সাথে আমি একমত এবং সেখান থেকেই পরিমার্জন করে এই পোস্ট টি লিখছি।

ইংরেজিতে লেখা অরিজিনাল পোস্ট পড়তে পারবেন এখানে

“কেন কিছু কোম্পানি আমাদের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাওয়া এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার মত সফলতা অর্জন করতে পারে?”

দর্শকদের এই প্রশ্নটি করে সাইমন সিনেক তার বিখ্যাত টেড টক শুরু করেছিলেন। অ্যাপল কেন এত অবিশ্বাস্য সফলতা পেয়েছে এবং একই ধরনের রিসোর্স থাকা সত্ত্বেও কেন অন্যরা ব্যর্থ হয়েছে, এটাই তার আলোচনার মূল বিষয়। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার ‘স্টার্ট উইথ হোয়াই’ থিওরিতে।

সাইমন সিনেকের মতে অ্যাপল এবং অন্যান্যদের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে কেন দিয়ে শুরু করা।

আপনার হয়তো মনে হতে পারে এর মানে কী! এই ধারনা ব্যাখ্যা করার জন্য সাইমন সিনেক একটা ডায়াগ্রাম ডেভেলপ করেছেন, যাকে তিনি গোল্ডেন সার্কেল বলেন।

golden-circle
Golden Circle by Simon Sinek from the book ‘Start with Why’

১. কেন – এটা একটা কোম্পানির মূল বিশ্বাস। এটাই সেই কারণ যার জন্য এই কোম্পানিটার অস্তিত্ব আছে বা সৃষ্টি করা হয়েছে।
২. কিভাবে – কোম্পানি তার বিশ্বাসকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দেয় তা থাকবে এই অংশে।
৩. কী – কোম্পানির মূল বিশ্বাসকে বাস্তবায়ন করতে কী করে।

একদম সিম্পল মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু সিনেক দেখেছেন যে বেশিরভাগ কোম্পানি তাদের মার্কেটিং এর কাজ করে উল্টা। তারা শুরু করে “কী” থেকে এবং তারপর যায় “কিভাবে” তে। বেশিরভাগ কোম্পানি অবহেলা করে কেন করে সেটাই বলতে ভুলে যায়। তার চাইতেও আশ্চর্যের কথা অনেকে জানেই না যে তারা যা করছে আসলে কেন করছে!

কিন্তু অ্যাপল শুরু করে “কেন” থেকে। এটা তাদের মার্কেটিং এর মূল বিষয়বস্তু এবং তাদের ব্যাবসায়ের চালিকা শক্তি। এই পয়েন্টটা আরও ভালোভাবে বুঝার জন্য কল্পনা করুন, যদি অ্যাপল তাদের মার্কেটিং ক্যাম্পেইন “কী” দিয়ে শুরু করতো।

“আমরা অসাধারণ কম্পিউটার বানাই। এগুলো ইউজার ফ্রেন্ডলি, সুন্দর ডিজাইন, ব্যবহার সহজ। একটি কিনতে চান?”

এই কথা গুলো কিন্তু আসলেই সত্য। কিন্তু তেমন আগ্রহ তৈরি করছে না। অন্য আর দশটা বিজ্ঞাপনের কপির মতই মনে হচ্ছে। মানুষ জানতে চায় কেন তারা অসাধারণ এবং ইউজার ফ্রেন্ডলি। অ্যাপল এই বিষয়টি অনেক বছর আগেই উপলব্ধি করেছে এবং খুব ভালোভাবেই ব্যাপারটা বোঝে। অ্যাপলের আসল মার্কেটিং মেসেজ টা দেখতে এমন-

“আমরা বাকি সবার থেকে আলাদা কিছু করার চেষ্টা করি। আমরা ভিন্নভাবে চিন্তা করি। আমাদের প্রডাক্ট ইউজার ফ্রেন্ডলি, সুন্দর ডিজাইন এবং ব্যবহার করা সহজ। আমরা অসাধারণ কম্পিউটার তৈরি করি। একটি কিনতে চান?”

একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে না? কারণ অ্যাপল যখন তার কোম্পানি সম্পর্কে বলে, তখন শুরু করে “কেন” দিয়ে। এটা ঠিক সেই মানুষগুলোকে আকর্ষণ করে যারা একইধরনের বিশ্বাসে আস্থা রাখে। সাইমন বলেন, “মানুষ কেয়ার করে না আপনি কী বিক্রি করছেন। মানুষ আসলে কেয়ার করে আপনি কেন করছেন।” কেন দিয়ে শুরু করার কারণে অ্যাপল একটা ফিচারে ভরপুর কম্পিউটার কোম্পানির থেকে বেশি কিছু হতে পেরেছে। এই কারণে প্রতিযোগী কোম্পানিদের মত একই রকম প্রযুক্তি নিয়েও তাদের আলাদা জায়গা তৈরি করেছে।

সাইমন সিনেকের এই থিওরি শুধু বিলিয়ন ডলার বিজনেসের জন্যই না। এটা যেকোনো দেশের, ছোট বড় যেকোনো আকারের কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য।

১. আপনার কোম্পানির “কেন” এর উত্তর খুঁজুন

আপনার কোম্পানির “কেন” এর উত্তর কি জানেন? (পয়সা আয় করা না।) আপনার কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য চিন্তা করুন, এবং তারপর চিন্তা করুন আপনি কিভাবে আপনার প্রডাক্ট এবং সার্ভিস মার্কেটিং করেন। এই দুইটি জিনিস কি একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ? সাইমন সিনেক যেমন খুঁজে পেয়েছেন, লয়্যাল কাস্টমার পেতে হলে আসলে সেই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে যারা আসলে আপনার মত একই মতবাদে বিশ্বাস করে। মনে রাখতে হবে- মানুষ আপনি কী করেন তা জানতে আগ্রহী না। আপনি যে কারণে করেন, তাতে বেশি আগ্রহী।

এটা অবশ্যই সকলের জানা কথা; কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা বেশিরভাগ সময় আমরা অসাবধানতাবশতঃ এড়িয়ে যাই। যদি আপনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি কি চাইবেন না যে মার্কেটিং বিভাগের মানুষ জানুক আপনি আসলে কোম্পানিটি কেন শুরু করেছিলেন? মানুষের কাছে “কিভাবে” এবং “কী” ব্যাখ্যা করার আগে “কেন” এর উত্তর অবশ্যই জানাতে হবে।

২. মার্কেটিং কপি এর মধ্যে “কেন” এর উত্তর রাখুন

“কেন” দিয়ে শুরু করা কপিরাইটিং এর জন্যও ভালো অভ্যাস। এরপর থেকে যখন আপনি ইমেইল লিখছেন, ব্লগ পোস্ট বা ল্যান্ডিং পেজ তৈরি করছেন, তখন “কেন” দিয়ে শুরু করুন। “কেন” আসলে আপনি যা প্রচার করতে চাচ্ছেন তার মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরে। এই বাক্য দুটিকে একটি কাল্পনিক মেইল হিসেবে বিবেচনা করুন:

“অবশেষে প্রকাশ হলো আমাদের নতুন ইবুক- সোশ্যাল মিডিয়া থেকে লিড জেনারেট করার ৭ উপায়। এতে আমরা আপনার বিজনেসের জন্য লিড জেনারেট করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ৭ টি কার্যকর উপায় বর্ণনা করেছি।”

অথবা…

“গত দশকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবসায়ের জন্য শক্তিশালী অবলম্বন হয়ে উঠেছে। লিড জেনারেশনের জন্য প্রতিদিন শত শত কোম্পানি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। আমাদের নতুন ইবুক-এ আমরা আপনাকে লিড জেনারেশনের সাতটি কার্যকর উপায় বর্ণনা করেছি। এখনি ডাউনলোড করুন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে লিড জেনারেট করার ৭ উপায়।”

হাবস্পট এই ধরনের কপি টেস্ট করে পেয়েছে যে দ্বিতীয় ইমেইল কপিটি আশ্চর্যরকম বেশি ক্লিক থ্রু রেট পেয়েছে। মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরার সাথে সাথেই আপনি পাঠকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবেন আর সেই মুহূর্তে দরকার শুধু ডিটেইলস (কিভাবে এবং কী) দিয়ে ডিল টা ক্লোজ করা।

৩. বায়ার পার্সোনা রিডিফাইন করা

আমি আবারও বলতে চাই, মানুষ আপনি কী করেন তা জানতে আগ্রহী না। কেন করেন সেটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

এটা মাথায় রেখেই আপনার বায়ার পার্সোনা গুলো সম্পর্কে চিন্তা করুন-

ক. এগুলো কি একেবারে টার্গেটেড ডেমোগ্রাফিকস এবং অনুমান করা স্বভাবের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা?
খ. এরা কি আসলেই আপনার চিন্তাধারার সাথে একমত?
গ. এমন কি আছে যা আপনার প্রডাক্ট কিনতে তাদের আকৃষ্ট করে এবং লম্বা সময় ধরে লয়্যাল থাকতে উদ্বুদ্ধ করে?

আপনি যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানেন, চিন্তার কারণ নেই! আপনার কাস্টমারদের প্রোফাইল ফেলে দিয়ে নতুন করে বানাতে হবে না। শুধু তারা কে এবং কিভাবে তারা আপনার “কেন” এর সাথে মিলে, সেটা খুঁজে বের করে এড করে নিন। এতে করে তারা কেন আপনার প্রডাক্ট কিনে, তা আপনি চিন্তা করে খুঁজে পাবেন।

হতে পারে আপনি দেশি কোম্পানি আর আপনার প্রতিযোগী বিশাল কোন মাল্টিন্যাশনাল আর আপনার কাস্টমাররা দেশপ্রেম এর চেতনায় বিশ্বাসী। হতে পারে আপনি ভেজালমুক্ত পণ্য বিক্রি করছেন তাই আপনার কাস্টমাররা আপনার কোম্পানির প্রডাক্ট ভালোবাসে। কারণ যাই হোক, আপনার বায়ার পার্সোনা ঠিক করে আপনার “কেন” এর সাথে মিল তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আপনার ব্যাবসার সম্প্রসারণে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

এই ছিল স্টার্ট উইথ হোয়াই বইতে মার্কেটারদের জন্য উল্লেখ করা আমার মতে গুরুত্বপূর্ণ ৩ টি বিষয়। আমি আসলে বইটা পড়া শুরু করেছিলাম লিডারশীপ শেখার জন্য। সাইমন সিনেকের Start with Why আর Leaders Eat Last টা পড়া হয়েছে। এখন Find Your Why পড়ছি। চাইলে কমেন্ট সেকশনে আপনিও দুই এক লাইন শেয়ার করতে পারেন।

Comments

3 responses to “সাইমন সিনেক এর ‘স্টার্ট উইথ হোয়াই’ থেকে শেখার মত ৩ টি বিষয়”

  1. obiPlabon Avatar

    দারুন লেগেছে।

    সাইমন সিনেক-এর why নিয়ে জানার পর আমিও এ নিয়েই চিন্তা করতে ছিলাম। শুধুমাত্র কোন প্রোডাক্টে কিংবা সার্ভিসে সীমাবদ্ধ না থেকে নিজেকেও প্রশ্ন করা শুরু করে দিয়েছি। আমি কেন, আমি কেন পৃথিবীতে, কেন আমি বেঁচে আছি, কেন আমি এখানে লিখছি, সবকিছু। যেমন সিনেক বলেছেন “Start with why” এবং সত্যিই উত্তর পাবার পর সব বিষয়গুলি অনেক অর্থবহ হয়ে উঠে।

    1. Sekander Avatar

      নিজেকে প্রশ্ন করা খুবই ভালো অভ্যাস। তবে বেশি ডিপে চলে যাবেন না। তাহলে আবার existential crisis এ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ?

Leave a Reply